ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর জীবনী | Nhrepon.com

ইমাম আবু হানিফা রহঃ

Imam-abu-hanifa
ইমাম আবু হানিফা (র:) এর জীবনী

ভূমিকা

যুগে যুগে যে সকল মণীষীরা এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেছিলেন তাদের মাঝে ইমাম আবু হানিফা রহঃ ছিলেন অন্যতম।

জন্ম ও বংশ পরিচয়:
তার পূর্ণ নাম হল- আবু হানীফা আন নু’মান ইবনি সাবিত নোমান {যুতি বা যাওতী } ইবনে মুরযেবান । প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফায় ৫ সেপ্টেম্বর ৬৯৯ ইংরেজী মোতাবেক ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ
করেন।এবং ১৪ জুন ৭৬৭ ইংরেজী ১৫০ হিজরীতে বাগদাদ শহরে মৃত্যুবরণ করেন।নু‘মান,উপনাম-আবু হানিফা। এ নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। পিতার নাম- সাবিত। তিনি একজন তাবেয়ী ছিলেন। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রা) এর সাথে সাক্ষাত হওয়ার কারনে তিনি একজন তাবেঈ।ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন।

এঁরা হচ্ছেন-
১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. (ওফাত ৯৩ হিজরী)
২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. (ওফাত ৮৭ হিজরী)
৩) সহল ইবনে সাআদ রা. (ওফাত ৮৮ হিজরী)
৪) আবু তোফায়ল রা. (ওফাত ১১০ হিজরী)
৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রা. (ওফাত ৯৯ হিজরী)
৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. (ওফাত ৯৪ হিজরী)
৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রা. (ওফাত ৮৫ হিজরী)

তাঁর দাদা ছিলেন কাবুলের অধিবাসী । তৎকালীন সময়ে কাবুল ও আফগানিস্তান ছিল ইরানেরই অর্ন্তভূক্ত । ‌‌তাঁর পিতা ছাবিত শৈশবে ইসলাম গ্রহণের পর হযরত আলী রাঃ এর দরবারে হাজির হলে তিনি তার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বরকতের দোয়া করেন । আর সেই দোয়ার বরকতে ।ছাবিত পরিবারের কোল আলোকিত করে জন্ম গ্রহণ করেন জগদ্বিখ্যাত মণীষী নূমান বিন ছাবেত রহঃ ।

মুরযেবান ছিলেন পারস্য অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট ভূম্যাতিপতি। তাঁর পুত্র যুতী যুদ্ধবন্দিরূপে কুফায় আসেন। ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর তাঁর নামকরণ করা হয় নোমান। তিনি কূফার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন।

পেশা

ইমাম আবু হানীফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। তৎকালীন বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়া-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তাঁর নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। তাঁর অন্যতম বিশিষ্ট সাগরেদ ইমাম মুহম্মদকে তিনি বাল্যকাল থেকেই লালন-পালন করে প্রতিষ্ঠার চুড়ান্ত শিখরে পৌছে দিয়েছিলেন। তাঁর অর্থ সাহায্যে লালিত এবং জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন শাখায় সুপ্রতিষ্ঠিত মনীষীবর্গের তালিকা অনেক দীর্ঘ।

কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাঁকে বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শা’বীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শা’বী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি! তুমি কোথায় যাওয়া-আসা কর?

ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শা’বী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে?

আবু হানীফা রহ. সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়। কিছুক্ষন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শা’বী আবু হানীফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম সাহেব বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু জোহরা) এ সময় আবু হানীফার রহ. বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর।

শিক্ষা- দীক্ষা

প্রথমত- তিনি ‘কূফা’ শহরেই ‘ইলমে ক্বালাম’ শিক্ষা করেন। অতঃপর কূফার শীর্ষস্থানীয় ফিকাহ শাস্ত্রবিদ ‘হাম্মাদ (রহ.)’ এর নিকট জ্ঞান আহরণ করতে থাকেন। তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর কাল ইমাম হাম্মাদের একান্ত সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনে নিমগ্ন থাকেন।

অতঃপর ১২০ হিজরীতে স্বীয় ওস্তাদ ‘হযরত হাম্মাদ ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্হলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রে কুফার ‘মাদ্রাসাতুর রায়’ এর পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন ৷ এখানেই তিনি খ্যান্ত হননি বরং তিনি কুফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা- মাদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শাইখদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন। আর মক্কা- মাদীনা যেহেতু স্থানীয়, বহিরাগত সকল উলামা, মাশায়েখ, মুহাদ্দিস ও ফকীহদের কেন্দ্রস্থল ছিল, কাজেই এক কথায় বলা চলে যে- মক্কা- মাদীনা ছিল ইলমের মারকায। আর তার মত অসাধারণ ধী- শক্তি সম্পন্ন, কর্মঠ ও মুজতাহিদ ইমামের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর যাবত মক্কা- মাদীনার ইলম হাসিল করা নিংসন্দেহে সাধারণ ব্যাপার নয়।

এছাড়া তিনি ৫৫ বার পবিত্র হাজ্জব্রত পালন করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় (উকূদুল জামান, পৃ- ২২০)। প্রত্যেক সফরেই তিনি মক্কা- মাদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত উলামা, মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসিনের সাথে সাক্ষাৎ করতেন।

আল্লামা আলী আল কারী, মুহাম্মাদ ইবনি সামায়াহ’র বরাত দিয়ে বলেছেন- ‘আবু হানীফা (রহ.) তার রচিত গ্রন্থগুলোতে সত্তর হাজারের উর্দ্ধে হাদীস বর্ননা করেছেন। আরالاثار গ্রন্থটি চল্লিাশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে লিখেছেন’ (আল জাওয়াহিরুল মযিয়াহ, খ- ২, পৃ- ৪৭৩)।

সেই সাথে ‘ইরাক’ এর অনন্য ইমাম বলে বিবেচিত হন এবং অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেন এবং ‘বসরাহ’, ‘মক্কা’, ‘মাদীনা’ ও ‘বাগদাদ’ এর তদানীšতন সকল প্রসিদ্ধ ও শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কিরামের সাথে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করেন এবং একে অপর থেকে উপকৃত হতে থাকেন। এভাবেই ক্রমশ তার সুখ্যাতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইলমী ময়দানে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।তিনি ‘‘হানাফী মাযহাবে’’র প্রবর্তক ছিলেন।যে মাযহাবের গুরুত্ব ও জনপ্রীয়তা এত অধিক হয়ে গিয়েছিল যার জন্য আজো তিনি ‘‘ইমাম আযম’’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন এবং প্রসিদ্ধ চার ইমামের মাঝে তাঁকেই শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি হাদীস শাস্ত্রেও অতুলনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন বলে বিভিন্ন লেখক মšতব্য করেছেন (আস সুন্নাহ, পৃ- ৪১৩, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩, খইরতুল হিসান, পৃ- ২৩। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনি ইউসূফ আস সালেহী ‘উকূদুল জামান গ্রন্থে দীর্ঘ ২৪ পৃষ্ঠায় ইমাম সাহেবের মাশায়েখদের একটা ফিরিস্ত পেশ করেছেন, উকূদুল জামান, পৃ- ৬৩- ৮৭)।****

শিক্ষাদান পদ্ধতী

ইমাম সাহেবের দরছগাহ সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকতো। শুক্রবার ও শনিবার। শনিবার দিনটি তিনি ব্যবসায়িক কাজকর্ম এবং পারিবারিক ব্যস্ততার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতেন। শুক্রবার দিন জুমার প্রস্তুতি এবং জুমাবাদ তার বাসস্হানে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনেরা সমবেত হতেন। এ দিন বিশেষ যত্নের সাথে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের খানা প্রস্তুত হতো। ইমাম সাহেব সমবেত সবাইকে নিয়ে খানা খেতেন।

কর্মদিবস গুলিতে তিনি এশরাক থেকে চাশতের সময় পর্যন্ত ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতেন। জোহরের পর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত থাকতেন। ফতোয়া দানের জন্যও এ সময়টাই নির্ধারিত ছিল। তবে অবস্হা ভেদে এ সময়সূচীর মধ্যে পরিবর্তনও হতো।ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধীক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।

স্বভাব-চরিত্র ও তাকওয়া, গুণাবলী

ইমাম আবু হানিফা [রহঃ] এর উন্নত চরিত্র, আমানতদারী, উদারতা, বিশ্বস্ততা, মহানুভবতা ছিল সর্বস্বীকৃত। যার জীবনের এক অবিচ্ছিদ্য অংশ কেটে গেছে ইবাদত গোযারিতে। রাতের প্রহরগুলো যিনি মওলা পাকের দরবারে রোনাযারিতে কাটিয়ে দিতেন।ইশকে রাসূলের তাড়নায় যিনি ৫৫ বার রাসূলের রওযা মোবারকে ছুটে গিয়েছিলেন।শুধু এক রমজানেই ওমরা করেছেন ১২০ বার।চল্লিশ বছর তিনি এশার উযূতেই ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। ইমাম আবু হানিফা অসংখ্য গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি একাধারে ৩০ বছর রোযা রেখেছেন এবং ৪০ বছর যাবৎ রাত্রে ঘুমাননি। প্রতি রমযানে ৬১ বার পবিত্র কুরআন মজিদ খতম করতেন।অনেক সময় এক রাকাতেই কুরআন মজিদ এক খতম দিতেন। তিনি ৫৫ বার হজ্জ করেছেন। ৯৯ বার আলস্নাহ তায়ালাকে স্বপ্নে দেখেছেন।

রচনাবলী

তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ হলো-

১• মুসনাদে আবু হানিফা
২• আল ফিকহুল আকবর
৩• ওয়াসিয়াতু আবু হানিফা
৪• কিতাবুর আছার লি আবি হানিফা।

ক্বাযীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি ও শাহাদাত বরন

তৎকালীন খলীফা মনসূর তার রাজত্ব স্থায়ী করার লক্ষ্যে ইমাম আবূ হানিফা [রহঃ] কে তার খিলাফতের প্রধান ক্বাযী নিযুক্ত করার ইচ্ছা করল।কিন্তু ইমাম আবূ হানিফা রহঃ এমন লোভনীয় পদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।কারণ, তিনি এ বিষয়ে ভালভাবেই জানেন যে,সরকারী পদে কর্মরত থেকে সুষ্ঠু বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়।যখন খলীফার বিষয়টি জানতে পারল তখন সে এ মর্মে বার্তা পাঠাল যে,ক্বাযীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে কারাগারকে নিজের জন্য বেছে নিন।পরে ইমাম আবু হানিফা [রহঃ] বিষয়টি তাঁর মাতাকে জানালে তাঁর মাতাও পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ক্বাযীর পদ গ্রহণ করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন।তবুও তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে,ইবনে হুবায়রার দুনিয়াবী শাস্তি আমার জন্য পরকালের কঠিনআযাবের তুলনায় সহজ।যদিও সে আমাকে হত্যাও করে ফেলে । খোদার কসম এ পদ গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব । শেষে খলীফা তার স্বার্থ চরিতার্থ করতে না পেরে ইমামকে কারাবন্দী করে রাখে এবং প্রতিদিন তাঁকে কারাগারের বাহিরে এনে জনসম্মুখে দশটি করে চাবুক মারা হতো তারপর তাঁকে চারিদিকে ঘুরানো হতো।এ পদ্বতিতে বারদিন পর্যন্ত শাস্তি দেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। কারারুদ্ধ করে পানাহারে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তারপর একটা বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখা হয় ৷

চাবুকের আঘাতে ইমামের শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তের ছোপ পড়ে যায় । ক্ষতস্থান থেকে তাজা রক্ত জমিনের বুকে গড়িয়ে পড়ে আর লালে লাল হয়ে যায় কূফার মাটি।তবুও গলল না খলীফার পাষাণ হৃদয়।তার অন্তরাত্বা কেঁপে উঠেনি ক্ষণিকের জন্যও।৭০ বছরের এ নিরীহ ইমামের প্রতি চলতে থাকে নির্যাতনের ষ্টীমরোলার । সবশেষে এ মহান ইমামকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিষপান করানো হয়। ফলে এ মহান ইমাম ১৫০ হিজরীতে ৭০ বছর বয়সে সিজদাবনত অবস্থায় কারাগারের অভ্যন্তরে ইন্তেকাল করেন । তাঁর মত্যুর পর খলীফার রক্ষীরা তাঁর মত্যুকে ‘‘স্বাভাবিক মত্যু’’ বলে অপপ্রচার চালায় |

কিন্তু, দুনিয়ার চরম বাস্তবতা এটাই যে,সত্যকে হয়তো কথার নিগূঢ় বর্ণণায় অথবা ক্ষমতার অপপ্রয়োগে বেঁধে রাখা যাবে কিন্তু মিথ্যার জাল ছিন্ন করে একদিন সত্য প্রকাশ হতে বাধ্য ৷

ইন্তিকাল ও সমাধীস্থল

তিনি হিজরী ১৫০ সন মুতাবিক ৭৬৭ খ্রিঃ খলিফা মনসুর কর্তৃক প্রয়োগকৃত বিষক্রিয়ার ফলে কারাগারে ইন্তিকাল করেন। ।তাঁর প্রথম জানাজায় লোকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫০ হাজারেরও উপরে।৫/৬ দফায় তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ৷ নির্মম নির্যাতনের শিকার ইমাম আবু হানিফা মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে যান যে খলীফা মানুসর জনগনের অর্থ অন্যায়ভাবে দখল করে বাগদাদের যেই এলাকায় শহর নির্মান করেছে সে এলাকায় যেন এন্তেকালের পর তাঁকে দাফন করা না হয়। তার জানাজায় সর্বশেষ ইমামতি করেন তার পুত্র হাম্মাদ। তাকে খাজরান নামক স্থানে তার শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের মাঝখানে সমাহিত করা হয়।

দাফনের পরও বিশ দিন পর্যন্ত তাঁর কবরের পাশে জানাজার নামাজ আদায় করা হয়।তার জন্য লোকজন মৃত্যুর ২০ দিন পর্যন্ত প্রার্থনা করেছিল। পরবর্তীতে, অনেক বছর পর বাগদাদের পাশে আধামিয়াতে আবু হানিফ মসজিদ নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় আবু হানিফার নামে।

ইমাম আবু হানিফা রহ. ও নাস্তিকের কথোপকথন

বিসমিল্লাহীর রহমানির রাহীম

নাস্তিকঃ”তোমার খোদা কবে জন্মগ্রহন করেছেন ?”
আবু হানিফাঃ”আল্লাহ সময়, কাল,যুগের আগে থেকে আছেন।(তার কোন শুরু নেই)”
নাস্তিকঃ”পার্থিব জীবনের নমুনা থেকে বল”
আবু হানিফাঃ”৩ এর আগে বাস্তব কত সংখ্যা”
নাস্তিকঃ”২”
আবু হানিফাঃ”২ এর আগে বাস্তব কত সংখ্যা”
নাস্তিকঃ”১”
আবু হানিফাঃ”১ এর আগে কত বাস্তব সংখ্যা”
নাস্তিকঃ”নাই”
আবু হানিফাঃ”যদি তোমার পার্থিব সংখ্যা ১ এর আগে কোন বাস্তব কিছু
না থাকে তাহলে যিনি শাশ্বত তার আগে কি কিছু থাকতে পারে ?”

নাস্তিকঃ”তোমার খোদা কোন দিকে মুখ করে আছেন ?”
আবু হানিফাঃ”যদি কোন অন্ধকার স্থানে মোমবাতি আনা হয় সেটা কোন দিকে মুখ করে থাকে ?”
নাস্তিকঃ”সব দিকে”
আবু হানিফাঃ”যদি তোমার পার্থিব কৃত্রিম আলো সব দিকে মুখ করে থাকতে পারে তাহলে যিনি আলো তৈরী করেছেন তিনি কি পারেন না?”

নাস্তিকঃ”তোমার খোদা কী কঠিন, তরাল না বায়বীয়?”
আবু হানিফাঃ”মৃত ব্যক্তির পাশে কখনো ছিলেন ?”
নাস্তিকঃ”হ্যাঁ “
আবু হানিফাঃ”মৃত্যুর পর সে কথা বলে ?”
নাস্তিকঃ”অবশ্যি না”
আবু হানিফাঃ”মৃত্যুর আগে সে বলতে ,কথা বলতে পারে কিন্তু মরার পর সে নির্জীব আর বরফ হয় কেন ?কে তার এই অবস্থা করে ?”
নাস্তিকঃ”তার আত্মা চলে যায়”
আবু হানিফাঃ”আত্মা কেমন আমাকে বলতো কঠিন ,তরল না বায়বীয় ?”
নাস্তিকঃ”আমি জানি না”
আবু হানিফাঃ”যদি পার্থিব আত্মার কোন সংজ্ঞা না দিতে পার তাহলে কিভাবে আল্লাহ র আল্লাহর অবস্থা বলা সম্ভব”

নাস্তিকঃ”তোমার খোদা কোথায় থাকে ?”
আবু হানিফাঃ”তুমি বাটিতে যদি এক গ্লাস দুধ নিয়ে আস “
নাস্তিকঃ”ঠিক আছে”
আবু হানিফাঃ “বল এর মধ্যে মাখন কোথায় থাকে ?”
নাস্তিকঃ”সব খানে”
আবু হানিফাঃ “যদি মাখনের মত সৃষ্ট বস্তু দুধের সব জায়গায় থাকে তাহলে আল্লাহ কিভাবে একটি স্থা্নে থাকতে পারে? এটা তো বিরট আশ্চর্য!”

নাস্তিকঃ “জান্নাতে তো টয়লেট নাই তাহলে খাবার পর শৌচ কাজ করবে মানুষ কিভাবে ?”
আবু হানিফাঃ “মায়ের পেটে বাচ্চা ৯ মাস কিভাবে শৌচ কাজ করে , সেটার তো দরকার হয় না। তাহলে জান্নাতে দরকার হবে কিভাবে ? “
নাস্তিকঃ “কিভাবে জান্নাতে খাওয়ার আর উপভোগ করার পর এর জিনিস বাড়বে” আবু হানিফাঃ “যেভাবে জ্ঞান যত দান করা হয় তত বাড়ে”
এভাবে যুগে যুগে নাস্তিকেরা অপমানিত হচ্ছে ও হবে ।

- ঈমানে মুফাছছাল -
“আ-মানতু বিল্লাহি ওয়া মালা-ইকাতিহী ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসূলিহি ওয়াল ইয়াওমিল আ-খিরি ওয়াল ক্বাদরি খায়রিহী ওয়া শাররিহী মিনাল্লা- হি তায়ালা ওয়ালবা’ছি বা’দাল মাওত।”

অর্থঃ আমি বিশ্বাস করলাম আল্লাহর উপর, তাঁর ফিরিশতাগণের উপর, তাঁর আসমানী কিতাব সমূহের উপর, তাঁর রাসূলগণের উপর, পরকালের উপর এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের উপর, যা আল্লাহপাকের নিকট হতে হয়ে থাকে এবং মৃত্যুর পর পূনরায় জীবিত হওয়ার উপর।

3 comments: