বেহেশতি জেওর । পর্ব - ০১

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানাআশরাফ আলী থানভী (রঃ)

বংশ পরিচয়ঃ

আগ্রা-আয়োধ্যা যুক্তপ্রদেশের মুজাফফর নগর জিলার অন্তগত প্রসিদ্ধ শহর থানাভবনে ফারূকী বংশের চারটি গোত্রের লোক বসবাস করিতেন।তন্মধ্যে খতিব গোত্রই ছিল অন্যতম। থানাভবনে সুলতান শিহাব উদ্দিন ফাররূখ-শাহ্ কাবুলি ছিলেন হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশ্রাফ আলী থানভীর উধ্বতন পুরুষ। থানাভবনে
এই বংশে বিশিষ্ট বুযুর্গ ও ওলিয়ে কামেলগণ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। সুতারাং হযরত থানভীর পিতা হইলেন ফারুকী। হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী, শায়খ জালালুদ্দিন থানেশ্বরী, শায়খ ফরীদুদ্দীন গন্জেশকর প্রমুখ খ্যাতনামা বুযুর্গগণ এই বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। হযরত মাওলানা থানভী (রঃ)-এর পিতা জনাব মুন্সি আব্দুল হক ছাহেব ছিলেন একজন প্রবাবশালী বিত্তবান লোক। তিনি খ্যাতনামা দানশীল ব্যক্তি এবং ফার্সী ভাষায় একজন উচ্চস্তরের পন্ডিত ছিলেন।এতদ্ভিন্ন তিনি একজন বিচক্ষণ, দূরদর্শি এবং উচ্চ শ্রেণীর সাধক ছিলেন।

তাঁহার মাতৃকুল ছিল ‘আলভী’ অর্থাৎ হযরত আলীর বংশধর। হযরত মাওলানা থানভীর জননী চিলেন একজন দ্বীনদার এবং আল্লাহর ওলী।উচ্চস্তরের বুযুর্গ ও ওরিয়ে কামেল পীরজী এমদাদ আলী ছাহেব ছিলেন তঁহার মাতুল। তাহার মাতা মহ (নানা) মীর নজাবত আলী ছাহেব ছিলেন ফার্সী ভাষায় সুপন্ডিত ও লব্ধপ্রতিষ্ট প্রবন্ধকার। প্রত্যুপন্নমতিত্ব ছিল তার একটি গুণ। তিনি মাওলানা শাহ্ নেয়ায আহম্মদ বেরলভীর জনৈক বিশিষ্ট খলীফার মুরীদ ছিলেন।খ্যাতনামা বুযুর্গ হাফেজ মোর্তাজা চাহেবের সহিতও তাহার আধ্যাত্নিক যোগ সম্পর্ক ছিলো বলিয়া তিনি বেলায়তের দরজায় পৌঁছেন। এমন উচ্চ মযাদাশীল পার্থিব ঐশ্বর্যে ধনবান, সাথে সাথে ধর্মপরায়নতা সহিত নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন, এমন একটি সম্ভ্রান্ত ও প্রখ্যাত বংশে হাকিমুল উম্মত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, জামেয়ে শরীয়ত, বেদআত ও রুসুমাৎ এর মুল উৎপাটনকারী শাহ্ ছুফী হাজী হাফেয হযরত মাওরানা আশরাফ আলী খানভী চিশতী হানাফী জন্মগ্রহণ করেন। হযরত মাওলানা ছিলেন দুরদর্শী, দৃঢ়চেতা, সূক্ষ্মদর্শী, স্বাবলম্বী, সত্যপ্রিয়, খোদাভীরু, ন্যায়পরায়ন প্রভূতি মানবীয় গুণে গুনান্বিত। এই মহৎ গুণাবলি তিনি হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) হইতে পৈতৃকসূত্রে লাভ করিয়াছিলেন। আর মা’রেফাত বা আধ্যাত্নিকরুপ অমুল্য রত্ন লাভ করেন মাতৃকুল অর্থাৎ, হযরত আলী (রাঃ) হইতে।

জন্ম বৃত্তান্তঃ

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা থানভীর জন্ম বৃত্তান্ত অলৌকিক ঘঠনার সহিত জড়িত। তাহার পিতার কোন পুত্রসন্তান জীবিত থাকিত না। তদুপরি তিনি এক দুরারোগ্য আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসকদের পরামর্শে এমন এক ঔষদ সেবন করেন যাতে তাহার প্রজনন ক্ষমতা সম্পূর্ণ রূপে রহিত হইয়া যায় । ইহাতে হাকীমুল উম্মতের মাতামহী নেহায়েত বিচলিত হইয়া পড়েন।একদা তিনি হাফেজ গোলাম মোর্তজা ছাহেব পনিপতির খেদমতে এ বিষয়টি আরজ করেন। হাফেজ ছাহেব ছিলেন মজযুব। তিনি বলিলেনঃ “ওমর ও আলীর টানাটানিতেই পুত্র-সন্তানগুলি মারা যায়।এবার পুত্র-সন্তান জন্মিলে হযরত আলীর সোপর্দ করিয়া দিও। ইনশাআল্লাহ জীবিত থাকিবে।” তাঁহার এ্ই হেঁয়ালী কেহই বুঝিতে পারিলেন না। পূর্ণ কথার সারমর্ম একমাত্র মাওলানার বুদ্ধিমতি জননীই বুঝিলেন আর তিনি বলিলেন, হাফেজ ছাহেবের কথার অর্থ সম্ববতঃ এই যে, ছেলেদের পিতৃকুল ফারূকী, আর ইম হযরত আলী (রাঃ) এর বংশধর। এযাবৎ পুত্রসন্তানদের নাম রাখা হয়ে ছিলো পিতার নামানুকরনে, অর্থাৎ হক শব্দ যোগে রাখা হইয়াছিলো।যেমন আব্দুল হক, ফজলে হক ইত্যাদি । এবার পুত্র সন্তান জন্মিলে মাতৃকুল অনযায়ী নাম রাখিতে। অথ্যাৎ আমার উর্ধ্বতন আদি পুরুষ হযরত আলী (রাঃ) এর নামের সহিত মিল রাখিয়া নামানুকরণ এর বলিতেছেন। ইহা শুনিয়া হাফেজ সাহেব সহাস্যে বলিয়া উঠিলেন, বাহবা ! মেয়েটি বড়ই বুদ্ধিমতি বলিয়া মনে হয়। আমার উদ্দেশ্য ইহাই ছিল। ইহার গর্ভে 2টি ছেলে হইবে। ইনশাআল্লাহ উভয় বাচিয়া থাকিবে এবং ভাগ্যবান হইবে। একজনের নাম রাখিবে আশ্রাফ আলী অপর জনের নাম রাখিবে আকবর আলী। একজন হইবে আমার অনুসারী, সে হিইবে আলেম ও হাফেজ। অপর জন হইবে দুনিয়াদার বস্তুত ঃ তাহাই হইয়া ছিল। আল্লাহ পাক কে বুজুর্গের দ্বারা হযরত থানবী মাতৃ-গর্ভে আসার পূর্বে অথ্যাৎ আলমে আরওয়াহে থাকাকালীন তাহার নাম রাখাইয়া দিলেন।আল্লাহ পাকের কত বড় মেহেরবানী কত বড় সৌভাগ্যের কথা।

জন্ম :

হিজরী ১২৮০ সনের ৫ই রবিউস সানী বুধবার ছোবহে ছাদেকের সময় হাকীমুল উম্মত জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। হাফেজ গোলাম মর্তুজা সাহেবের নির্দেশ ক্রমে নবজাতের নাম রাখা হল আশ্রাফ আলী। তাহার জন্মের ১৪ মাস পরে তাহার ছোট ভাই আকবর আলীর জন্ম হয়। থানা ভবনের অধিবাসী বলিয়া তাঁহাকে থানবী বলিয়া অবহিত করা হয়।

বাল্যকাল ঃ

মাওলানার পাঁচ বছর বয়স কালে তাঁহার পূণ্যশীলা স্নেহময়ী জননী পরলোক গমন করেন। শিশুকালেই দুই ভাই মাতৃস্নেহ হইতে বঞ্চিত হইলেন। কিন্তু পিতা জননীর ন্যায় স্নেহ মমতায় উভয় শিশুর লালন পালন ও তালীম তবিয়তের ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন। তিনি উভয়কেই কুবই স্নেহ করিতেন। স্বহস্তে গোসল করাইতেন, স্বহস্তে খাওয়াইতেন। পিতার অত্যাধিক আদর যত্নের কারণে শিশুরা মায়ের বিচ্ছেদ-বেদনার কথা কখনও অনুভব করিতেই পারে নাই।

শৈশব হইতেই হযরত হাকীমুল উম্মতের চাল-চলন ও আচার-ব্যবহার ছিল পাক পবিত্র ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তিনি কখনও বাহিরের ছেলেদের সহিত খেলাধুলা করিতেন না। ছোট ভাই আকবর আলীকে নিয়া নিজ বাড়ীর সীমার মধ্যে খেলাধুলা করিতেন। খেলা ধুলার সময় ধুলাবালি গায়ে ও কাপড়ে লাগিতে দিতেন না। সময়ে বৃষ্টিতে ভিজিয়া উভয় ভ্রাতা আনন্দ উপভোগ করিতেন। হযরত মাওলানা বাল্যকালে নেহায়েত শান্ত ও সুশীল ছিলেন। তাহার সু-মধুর ব্যভহারে বিধর্মীরাও তাঁহাকে অত্যান্ত স্নেহের চোখে দেখিত।

সাধারণত: ছেলেরা মসজিদে বা উৎসব উপলক্ষে শিরনী মিঠাই ইত্যাদি পাইবার সুযোগ গ্রহণ করে। হযরত মাওলানার বিচক্ষন ও দূরদর্শী পিতা ইহা আদৌ পচন্দ করিতেন না। তিনি বরং বাজার থেকে মিঠাই আনিয়া দুই পুত্রের হাতে দিয়া বলিতেন, মিঠাইয়ের জন্য মসজিদে যাওয়া বড়ই লজ্জার কথা। হযরত হাকীমৃল উম্মতের মেধাশক্তিও ছিল অসাধারণ। বিদ্যালয়ের দৈনিন্দিনের পাঠ সহজেই কন্ঠস্থ করিয়া ফেলিতেন। কাজেই পিতা বা ওস্তাদগণ কেহই তাঁহাকে তিরস্কার বা ভর্ৎসনা করার সুযোগ পাইতেন না; বরং ওস্তাদগলণ তাঁহাকে আন্তরিক স্নেহ করিতেন। তিনি ধর্ম কর্মে অত্যান্ত অনুরাগী ছিলেন। এজন্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই তাঁহাকে স্নেহ করিত। কেহই তাঁহার কাজের প্রতিবাধ করিতোনা। এমনকি অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করিতোনা। দেওয়ালী পুজার মিরাটের চাওনী বাজারের রাস্তার দুই ধারে সারি বাঁধিয়া অসংখ্য প্রদীপ জালান হইত। তাহারা দুই ভাই রুমালের সাহায্যে বাতাস দিয়া একাধারে সকল প্রদীপ নিবাইয়া দিতেন। এজ্য কেহই তাঁহাদের কিছু বলিতো না; এমনকি হিন্দুরাও কিছু বলিতোনা। তিনি খেলার মধ্যে নামাজের অভিনয় করিতেন। সহপাঠীদের জুতা গুলিকে কেবলা মুখি সারি করিয়া সাজাইতেন এবং একটি জুতা সারির সম্মুখে স্থাপন করিয়া সঙ্গীদেরকে বলিতেন, দেখ, দেখ, জুতাও জামাতে নামাজ পড়ে। এই বলিয়া বেশ আনন্দ উপভোগ করিতেন। ইহাতে বুঝা যায়, জামাতে নামাজ পড়ার প্রতি তাঁহার অন্তরে কত আকর্ন ও ভালবাসা ছিল। তিনি খেলাধুলায় অযথা সময় নষ্ট করিতেন না। বরং দোয়া দরুদ পড়িতে থাকিতেন।

তাঁহার বয়স যখন ১২/১৩ বৎসর তখন তিনি শেষ রাত্রে উঠিয়া তাহাজ্জুদের নামাজ পড়িতেন। গভীর রাত্রে একাকি নামাজ পড়িতে দেখিয়া তাঁহার চাচি আম্মা বলিতেন, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার সময় তোমার এখনও হয় নাই, বড় হইলে পড়িবে। ইহাতে কোন ফল হইল না; বরং তিনি রীতিমত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়িতে রহিলেন। চাচী আম্মা নিরুপাই হইয়া তাহাজ্জুদ নামাজে মশগুল থাকা কারীন তাহাকে পাহারা দিতেন। কারণ, ছেলে মানুষ গভীর রাত্রে একাকি ভয় পাইতে পারে।

ছোট বেলা হইতেই তিনি ওয়ায বা বক্তৃতা করিতে অভ্যস্ত ছিলেন। সময় সময় সওদা আনিবার জন্য তাঁহাকে বাজারে যাইতে হইতো।পেথি মধ্যে কোন মসজিদ দেখিতে পাইলে ইহাতে ডুকিয়া পড়িতেন এবং মিম্বারে দাড়াইয়া খোৎবার ন্যায় কিছু পড়িতেন। অথবা কিছু ওয়াজ নছিহত করিতেন। এরুপে তিনি ছোট বেলাই ওয়াজের ক্ষমতা অর্জন করিতে সক্ষম হন। ফলে তিনি উত্তর কালে বিখ্যাত ওয়ায়েজ বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

হযরত হাকীমুল উম্মত যখন সবে মাত্র মক্তবের ছাত্র তখন কুত্‌বুল আকতাব হযরত মিয়াজী নুর মোহাম্মদ ছাহেবের খাছ খলিফা হযরত শায়খ মুহাম্মদ মুহাদ্দেস (ইনি হাজী ইমদাদুল্যাহ মুহাজিরে মক্কীর পীর-ভাই) বলিতেন। এই বালক উত্তর কালে আমার স্থলাভিষিক্ত হইবে। হযরত হাকীমুল উম্মত বালকালে যখন গৃহের বাহিরে যাইতেন, তখন আকাশের মেঘ মালা তাঁহাকে ছায়া দিত। আল্লাহর ওলী এবং যথার্থ অর্থে “নায়েবে রসূল” হওয়ার ইহাই একটি উজ্জল নিদর্শন।

একটি স্বপ্ন :

হযরত হাকীমুল উম্মত বাল্যকালে একটি তাৎপর্য পূর্ণ স্বপ্ন দেখেন। তিনি বলেন, স্বপ্নে আমি দেখিলাম, আমি মীরাটের যেই বাড়ীতে থাকিতাম ইহাতে উঠিবার দুইটি সিঁড়ি ছিল, একটি বড় একটি ছোট। আমি দেখিলাম, বড় সিঁড়িটির একটি পিঞ্জিরায় দুইটি সুন্দর কবুতর। অতঃপর যেন চারিদিকে সন্ধার অন্ধকারে ছাইয়া গেল। তখন কবুতর দুইটি আমাকে লক্ষ করিয়া বলিলঃ আমাদের পিঞ্জিরাটিকে আলোকিত করিয় দিন। উত্তরে আমি বলিলাম, তোমরা নিজে রাই আলোকিত করিয়া লও। তখন কবুতর দ্বয় নিজেদের ঠোঁট পিঞ্জিরার সহিত ঘর্ষন করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে খাঁচাটি এক উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হইয়া গেল।

কিছুদিন পর এই স্বপ্নেরস কথা তিনি তাঁহার মামা ওয়াজেদ আলী সাহেবের নিকট ব্যক্ত করিলে তিনি ইহার তা’বীর এই করিলেন যে, কবুতর দুইটি হইল ‘রুহ’ অপরটি ‘নফস’ মোজাহাদা বা সাধ্য-সাধনার মাধ্যমে তাহাদিগকে নূরানী করিতে আবেদন করিয়াছিল। কিন্তু তোমার কথায় তাহারা নিজেরাই নিজেদেরকে নুরানী করিয়া লইল। ইহাতে বুঝা যায়-যিয়াযত ও মোজাহাদা ব্যতিরেকেই আল্লাহ পাক তোমার রুহ ও নফ্সকে উজ্জ্বল করিয়া দিবেন। কালে এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হইয়অছিল। শৈশব হইতেই তিনি ছিলেন নাযুক তবিয়তের। তিনি কাহারো নগ্ন পেট দেখিতে পারিতেন না। অনাবৃত পেট দেখা মাত্র বমি হইয়া যাইত। যে গৃহে কোন প্রকার তীব্র সুগন্ধ থাকিত তথায় তিনি ঘুমাইতে পারিতেন না আর দূর্গন্ধের তো কোন কথাই নাই। কোন জিনিস এলোমেলো দেখিলেই তৎক্ষণাৎ তাঁহার মাথা ব্যথা আরম্ভ হইয়া যাইত।

শিক্ষা ব্যবস্থা :

হযরত মাওলানা থানবী (র:) কোরআন মজীদও প্রাথমিক উর্দূ, ফার্সী কিতাব মীরাটে শিক্ষা লাভ করেন। পরে থানা ভবন আসিয়া তদীয় মাতুল ওয়াজেদ আলী সাহেবের নিকট শিক্ষা লাভ করেন। অতপর আরবীতে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য ১২৯৫ হিজরীতে বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “দেওবন্দ দারুল উলূম মাদ্রাসায়” গমন করেন। মাত্র ৫বৎসরেই দেওবন্ধের শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া দেশে প্রত্যাগমন করেন। তখন তাঁহার বয়স ছিলি মাত্র 19 বৎসর। এই সময়ের মধ্যে এলমে হাদীস, এলমে তফসীর, আরবী সাহিত্য, অলংকার শাস্ত্র, সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞান শাস্ত্র, সৌরবিজ্ঞান, দর্শন শাস্ত্র, ইসলামী আইন শাস্ত্র, নৈতিক চরিত্র বিজ্ঞান, মসস্তত্ত্ববিজ্ঞান, মূলনীতি শাস্ত্র, প্রকৃতি বিজ্ঞান, উদ্ভিদ ও প্রাণী বিজ্ঞান, ইতিহাস ও যুক্তি বিজ্ঞান,আধ্যাত্মিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদি বাইশটি বিষয়ের জটিল কিতাব সমূহ অতি কৃতিত্বের সহিত অধ্যয়ন করেন। এ সময় তিনি “জের ও বম” নামে একটি ফার্সি কাব্য রচনা করেন।

দেওবন্দে দুইটি স্বপ্নঃ

১. একবার তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, িএকটি কুপ হইতে রৌপ্য শ্রোত প্রবাহিত হইয়া তাঁহার পিছনে পিছনে ধাবিত হইতেছে।

২. আর একবার তিনি স্বপ্নে দেখেন জনৈক বুযুর্গ ও কোনে এক দেশের গভর্ণর, এই দুই ব্যক্তি তাঁহাকে দুইখানা পত্র লেখেন। উভয় পত্রেই লেখা ছিল যে, আমরা আপনাকে মর্যাদা প্রদান করিলাম” । ঐ পত্রের একটিতে হযরত নবী করীম (সাঃ) এর নামের মোহর অঙ্কিত ছিল। উহার লেখাটি বেশ স্পষ্ট ও সুন্দর ছিল। অপর পত্রের মোহরের ছাপ অস্পষ্ট থাকায় পড়া যাইতেছিল না। হযরত মাওলানা এই উভয় স্বপ্ন দেওবন্দের প্রধান অধ্যক্ষ ও পরম শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ হযরত মাওলানা ইয়াকুব ছাহেবের নিকট ব্যক্ত করেন। প্রথম স্বপ্নের তা’বীরে মাওলানা বলিলেন, দুনিয়ার ধন-দৌলত তোমার পায়ে লুটাইয়া পড়িবে, অথচ তুমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করিবেনা। দ্বিতী স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলিলেন। ইনশাআল্লাহ দ্বীন ও দুনিয়ায় তোমার যথেষ্ট মান সম্মান হইবে। এ সময় উক্ত ওস্তাদ ছাহেব তাঁহার দ্বারা ফত্‌ওয়া লিখাইতেন। ওস্তাদের প্রতি তাঁহার প্রগাঢ় ভক্তি ছিল। তিনি ওস্তাদের যথেষ্ট খেদমত করিতেন। ফলে তিনি ছাত্র জীবনে “আশরাফুত্তালাবা” েএবং কর্ম জীবনে “আশরাফুল ওলামা” নামে খ্যাতি লাখ করেন। যেমনি নাম তেমনি কাম।

দারুল উলূমের অধ্যয়ন শেষে কৃতী ছাত্রদের যথারীতি পাগড়ী পুরুষ্কার দেওয়া হয়। এব বৎসর কুত্‌বে আ’লম হযরত মাওলানা রশীদ আহ্‌মদ গঙ্গোহী ছাহেব (র:) স্বীয় পবিত্র হস্তে হযরত মাওলানা থানবীর মাথায় পাগড়ী বাধিয়া দিলেন।এ সময় মাদ্রাসার ওস্তাদদের নিকট তাঁহার প্রতিভার প্রশংসা শুনিয়া হযরত গঙ্গোহী ছাহেব তাঁহাকে কতিপয় কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেন। হযরত মাওলানা ঐ সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করিলেনয়। এই প্রকার দূর্বোধ্য প্রশ্নের সঠিক উত্তর শুনিয়া হযরত গঙ্গোহী ছাহেব মুগ্ধ হন এবং তাঁহার জন্য দো’আ করেন। ফলে তিনি শিক্ষা সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ যোগ্যতা সম্পন্ন জগৎ বরেণ্য আলেম হিসাবে প্রশিদ্ধ হইয়া পড়েন।

অধ্যাপনা :

পাঠ্য জীবন শেষে ১৩০১ হিজরীতে কানপুর ফয়েযে ‘আম মাদ্রাসায় মাসিক পঁচিশ টাকা বেতনে অধ্যাপনার কাজ আরম্ভ করেন। হাদীস, তফ্‌সীর ও উচ্চ স্তরের কিতাব সমূহ কৃতিত্বের সহিত পড়াইতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ায নছীহতের মাধ্যমেও জনগণকে মুগ্দ্ধ করিয়া ফেলেন।এদিকে মধুর কন্ঠস্বর গুরুগম্ভীর সম্বোধন, মার্জিত ভাষা ও অপূর্ব বণর্ণা ভঙ্গী, অপর দিকে কোরআন ও হাদীসের সরল ব্যাক্ষা, মা’রেফত ও তাছাউফের সূক্ষ্ম বিষয়ের সহজ সমাধান।

মোট কথা ওয়াজের মাহ্‌ফিলে অফুরন্ত ভান্ডার হইতে অভাবনীয় মুল্যবান তত্ত্ব ও তথ্য বিকশিত হইতে থাকিত। ফলে শ্রোতাবৃন্দের অন্তরে বিশেষ প্রতক্রিয়া সৃষ্টি হইত। তাঁহার ভাষণ সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা হইত। জনসমাজে হযরত মাওলানার জনপ্রিয়তা দেখিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মধ্যে আর্থিক স্বার্থ লাভের বাসনা জাগরিত হয়। তাঁহারা তাঁহার ওয়ায মাহফিলে মাদ্রাসার জন্য চাঁদা আদায় করার কথা হযরত মাওলানার নিকট ব্যক্ত করিলেন। হযরত মাওলানা এই উপায়ে চাঁদা সংগ্রহ করা এলমী মর্যাদার খেলাফ ও না-যায়েজ মনে করিতেন। তাই তিনি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের আবেদন রক্ষায় অসম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। ইহাতে কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরস্পর নানা প্রকার কানা ঘুষা আরম্ভ হইল। এ কথা তাঁহার কর্ণগোচর হইলে তিনি মাদ্রাসার কার্যে ইস্তিফা দেন এবং সরাসরি বাড়ী চলিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত করেন। এল্‌মে দ্বীন ও দর্শন শাস্ত্রে এমন বিজ্ঞ ব্যক্তি দূর্লভ ভাবিয়া জনাব আবদুর রহমান খান ও জনাব কেফায়েত উল্যাহ সাহেব দ্বয় মাসিক ২৫ টাকা বেতনে টপকাপুরে অপর একটি মাদ্রাসায় অধ্যাপনার কাজের জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করেন। এল্‌মে দ্বীনের খাতিরে হযরত মাওলানা তাঁহাদের অনুরোধ রক্ষায় সম্মত হন। টপকাপুর জামে মসজিদের নামে নামানুসারে মাদ্রাসার নাম রাখিলেন জামেউল উলূম। আজো কানপুরে এই মাদ্রাসা বিদ্যমান আছে এবং তাঁহার স্মৃতি ঘোষনা করিতেছে।

তিনি একাধারে চৌদ্দ বৎসর জামেউল উলূমে এল্‌মে দ্বীন শিক্ষাদানে মষগুল থাকেন। অতপর ১৩১৫ হিজরীর ছফর মাসে স্বীয় মুর্শিদ শায়লুল আরব ও আ’জম কুত্‌বে আ’লম হযরত হাজী এমদাদুল্যাহ মোহাজেরে মক্কী ছাহেবের অনুমতিক্রমে কানপুরের সংস্রব ত্যাগ করিয়া থানা ভবনে আসিয়া উম্মতে মুহাম্মদীয়ার সংস্কার সাধনে আত্ম নিয়োগ করেন।

বুযুর্গগনের খেদমতে মাওলানা থানভী :

আল্লাহর ওলীগণের প্রতি হযরত হাকীমুল উম্মতের ভক্তি ও মহব্বত ছিল অত্যন্ত গভীর।

তিনি বলিতেন, আল্লাহর ওলীদের নামের বরকতে রুহ সজীব এবং অন্তরে নূর পয়দা হয়। তিনি প্রায়ই বলিতেন, তরীকতের পথে আমি রিয়াযত ও মোজাহাদা করি নাই। আল্লাহ পাক যাহা কিছু দান করিয়াছেন সমস্তই শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ ও বুযুর্গানে দ্বীনের আন্তরিক দো’আ ও তাওয়াজ্জুর বরকত পাইয়াছি।

যে মজযুব হাফেজ গোলাম মোরতাজার দো’আয় হযরত মাওলানার ইহজগতে আবির্ভাব হয়। এবং তাঁহার নাম করণ, “আশ্রাফ আলী” করেন। তিনি মাওলানাকে অত্যাধিক স্নেহ করিতেন। বালকাল হইতে তাঁহার অন্তরে খোদাপ্রেম বদ্ধমূল হওয়ার ইহাও অন্যতম কারণ বটে।

যখন দেওবন্দে হযরত মাওলানা রশীদ আহ্‌মদ গঙ্গোহী কুদ্দিসা সির্‌রুহু ছাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হয়। তখন তাঁহার পবিত্র নূরানী চেহারা দর্ন মাত্র তাঁহার হাতে বায়’আত হওয়ার প্রবল আখাংকা হযরত মাওলানা থানভীর অন্তরে জাগরিত হয়। কিন্তু ছাত্র জীবনে মুরীদ হওয়া সমীচীন নহে বলিয়া তাঁহার বাসনা পূর্ণ হয় নাই। ১২৯৯ হিজরীতে হযরত মাওলানা গঙ্গোহী ছাহেব (র:) হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ গমনকালে মাওলানা থানভী কুত্‌বুল আক্‌তাব হযরত হাজী ইমদাদুল্যাহ মোহাজেরে মক্কী ছাহেবের খেদমতে পত্রযোগে আবেদন করিলেন, তাঁহাকে বায়’আত করিবার জন্য যেন গঙ্গোহী ছাহেবকে বলিয়া দেন। যথা সময়ে পত্রের উত্তর আসিল। পত্রে লিখা ছিল- হযরত হাজী ছাহেব (র:) স্বয়ং তাঁহাকে মুরীদ করিয়াছেন। তখন তাঁহার বয়স মাত্র ১৯ বৎসর।

হযরত হাজী ছাহেব যখন মক্কায় হিযরত করেন, তখন হযরত থানভী (র:) ভূমিষ্টই হন নাই। অন্তশ্চক্ষু খুলিয়া গেলে স্থান কালের যাবতীয় পর্দা অপসারিত হইয় যায়। আ’রেফ বিল্লাহ হযরত হাজী ছাহেব পবিত্র মক্কায় থাকিয়াই থানা ভবনের এই মহামনিকে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। তিনি হযরত মাওলানার পাঠ্যজীবনে তাঁহার পিতাকে লিখিয়াছিলেন। যখন তুমি হজ্জ করিতে আসিবে, তখন তোমার বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়া আসিও।

১৩০১ হিজরী শাওয়াল মাস। হাকীমুল উম্মত কানপুর জামেউল উলূম মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করিতেছেন। তাঁহার পিতা পবিত্র হজ্জ ক্রিয়া পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ গমনের জন্য প্রস্তুত হইলেন। স্নেহের পুত্র হাকীমুল উম্মতও তাঁহার সঙ্গী হইলেন। যথা সময়ে পিতা-পুত্র পবিত্র মক্কা ভূমিতে হযরত হাজী ছাহেবের খেদমতে উপনীত হইলেন। ইহাই হইল তাঁহার সহিত হযরত মাওলানার প্রথম সাক্ষাৎকার। হাজী ছাহেব হযরত মাওলানার দর্শন লাভ করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন এভং হাতে হাতে তাঁহার বায়’আত করিলেন। তখন তাঁহার পিতাকেও বায়’আত করিলেন। পিতা-পুত্র উভয়ে এক মুর্শিদের হাতে বায়’আত হইলেন। হজ্জের পর হযরত হাজী ছাহেব, হাকীমুল উম্মতকে ছয়মাস তাঁহার খেদমতে অবস্থান করিতে বলিলেন, কিন্তু পিতার মন স্নেহের পুত্রকে একা দূরদেশে রাখিয়া যাইতে চাহিল না। অগত্যা হযরত ছাহেব বলিলেন, পিতার তাকেদারী অগ্রগণ্য, এখন যাও, আগামীতে দেখা যাইবে।

হজ্জ হইতে প্রত্যাগম করিয়া অধ্যাপনা, গ্রন্থ রচনা, তাবলীগ, ফতওয়া প্রদান ইত্যাদি কার্যে পূণরায় আত্ননিয়োগ করেন। এদিকে মুর্শিদের সহিত পত্র বিনিময় হইতে লাগিল। তিনি প্রায় সহস্রাধিক গ্রন্থ রচনা করেন।

১৩০৭ হিজরী হইতে হযরত মাওলানার নূতন জীবন আরম্ভ হইল। পার্থিব সহস্রব অপেক্ষা আধ্যাত্নিক উন্নতির দিকে তাঁহার মন ধাবিত হইল। হযরত ছাহেবের খেদমতে মাদ্রাসার সম্পর্ক ছিন্ন করার অনুমতি প্রার্থনা করিয়অ পত্র লিখিলেন। উত্তর আসিল, আল্লাহ্‌র বন্দাদেরকে দ্বীনের ফয়েজ পৌঁছান আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের উপায়। শ্রদ্ধেয় মুর্শিদের পরামর্শ শিরোধার্য। তাই এলমে দ্বীন শিক্ষা প্রদানের কাজ চালু রাখিলেন। এই ভাবে তিন বৎসর অতীত হওয়ার পর হিজরী ১৩১০ সালে হযরত মাওলানার ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গিয়া গেল। অনেক চেষ্টা করিয়াও মনকে। আর প্রবোধ দিতে পারিলেন না। আর মুরশিদ বলিয়াছিলেন, “মিয়া আশরাফ আলী, ছয় মাস আমার নিকট থাক”। মুর্শিদের সেই আহ্বান তৎক্ষনাৎ হযরত মাওলানার অন্তরে দাগ কাটিয়া গিয়াছিল। ঐ একই কথা বার বার তাঁহার অন্তরে তোলপাড় করিলে লাগিল। কি অদৈম্য আকর্ষন! অবশেষে দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পর মক্কা শরীফে গমনের অনুমতিপত্র আসিল। স্নেহের মুরীদ প্রাণপ্রিয় মুর্শিদের খেদমতে পৌঁছিয়া স্বস্থির নিশ্বাস ফেলিলেন। এবং মুর্শিদের পদতলে নিজের সত্ত্বা বিলীন করিয়া দিলেন। মুর্শিদও আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেন। অতি অল্প দিনের মধ্যেই পীর ও মুরীদ একই রং ধারণ করিলেন। হযরত হাজী ছাহেব নিঃ সংকোচে ফরমাইলেতন। মিয়া আশরাফ! তুমি তো সম্পূর্ণ আমার তরীকার উপর। হযরত মাওলানার কোন লিখা তাঁহার দৃষ্টি গোচর হইলে বলিতেন, আরে তুমি তো আমারই মনের কথা ব্যক্ত করিয়াছ।

হযরত হাজী ছাহেবের খেদমতে মা’রেফত সম্বন্ধে কেহ কোন কথা জানিতে চাহিলে তিনি হযরত মাওলানার দিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিতেন, একে জিঞ্জাসা কর, সে ইহা ভাল রুপে বুঝিয়াছে। ইহার কারণ, মুর্শিদ বুঝিতে পাইয়াছিলেন, মুরীদের আধ্যাত্নিক উন্নতি পূর্ণতার স্তরে পৌছিয়াছে। ছয় মাসের মাত্র এক সপ্তাহ বাকী থাকিতে হযরত মাওলানা সাহেবের খেদমত হইতে বিদায়ের অনুমতি চাইলেন তখন হযরত হাজী ছাহেব তাহাকে খাছ করিয়া দুইটি অছিয়ত করিলেন। ১. মিয়া আশ্‌রাফ আলী! হিন্দুস্তানে গিয়া তুমি একটি বিশেষ অবস্থার সম্মুখীন হইবে, তখন ত্বরা করিও না। ২. কানপুর হইতে মন উঠিয়া গেলে অন্য কোথাও সম্পর্ক স্থাপণ করিও না। আল্লাহর উপর ভরসা করিয়া থানা ভবনেই অবস্থান করিও। হিজরী ১৩১১ সনে প্রিয় জন্ম ভূমি থানা ভবনের আহ্বান হযরত মাওলানাকে বিচলিত করিয়া তুলিল। অবশেষে শ্রদ্ধেয় মুর্শিদের ওছিয়ত ও আধ্যাত্নিক সম্পদ সহ থানা ভবনে আসিয়া হাজির হইলেন।

হযরত হাজী ছাগেব কেব্‌লা হযরত মাওলানাকে এক অধিক স্নেহ করিতেন যে, কেহ মাওলানার পরিচয় জিঞ্জাসা করিলে তিনি তাঁহাকে নাতি বলিয়া পরিচয় দিতেন। অত্যধিকস্নেহ বশতঃ তিনি তাঁহাকে মিয়া আশ্‌রাফ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। একবার মুর্শিদে আ‘লা প্রিয়তম শিষ্যকে স্বীয় খাছ কুতুবখানা দিতে চাহিয়াছিলেন। হযরত মাওলানা আরয করিলেন, এই সব কিতাব তো আধ্যাত্নিকতার খোলস মাত্র, অনুগ্রহ করে উহার পরিবর্তে আমার ছিনায় কিছু দান করুন। প্রিয়তম শিষ্যের এমন গভীর তত্ত্বপূর্ণ আব্‌দার শুনিয়া মুর্শিদ বলিলেন, হ্যাঁ, সত্য বটে, কিতাবে আর কি আছে? সবই তো সিনায় রহিয়াছে। মুর্শিদের আন্তরিক দোয়ায় মাওলানা অন্তকরণ এল্‌মে মা’রেফতে ভরপুর হইয়া গেল। বিদায় গ্রহণকালে হযরত হাজী ছাহেব মুরাক্বাবা করিয়া বলিলে, আশ্চর্য! ইহার সম্মান কাশেম ও রশীদকে অতিক্রম করিয়া গেল।

বস্তুতঃ এই ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হইয়াছিল।

মুর্শিদের খেদমত হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া হযরত মাওলানা দেশে ফিরিয়া আসিলেন। অতপর চিঠি পত্রের আদান প্রদান চলিতে লাগিল। হযরত হাজী সাহেব হাজীদের মারফৎ বলিতেন, “আমার মিহিন মৌলভীকে সালাম বলিও।” এই মিহিন শব্দে হযরত মাওলানার চিক্ষণতা ও দূরদর্শিতা রুপ গুণাবলীর প্রতি ইঙ্গিত করিয়াছেন। পীর ও মুরিদের কী অপূর্ব সর্ম্পক, কী মায়া, কি ভক্তি!

হযরত মাওলানা দেশে ফিরিবার সময় কানপুরে বখ্‌শী নযীর হাসান ছাহেব স্বপ্নে দেখিলেন, হযরত মাওলানা জাহাজ হইতে অতরণ করিতেছেন।আর সারা হিন্দস্তান তাঁহার দেহের নূরে নূরানী হইয়া উঠিয়াছে। কালে এই স্বপ্ন বাস্তব রুপয়িত হইয়াছিল।

দেশে ফিরিয়া পুনরায় তিনি জামেউল উলুমে অধ্যাপনার কাজে আত্বনিয়োগ করেন। শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে মা’রেফতের আলো বিচ্ছুরিত হইল। এক কথায় মাদ্রাসা যিক্‌র আয্‌কারের খানক্বায় পরিণত হইল। বহু অমুসলিমও ইসলাম ধর্ম্ গ্রহণ করিয়া ধন্য হইল। চৌদ্দ বৎসর অধ্যাপনার পর হিজরী ১৩১৫ সালে কানপুর হইতে থানা ভবনে আসিয়া খানক্বায়ে এমদাদিয়ার আবাদে মশ্‌গূল হইলেন। হযরত মাওলানার থানা ভবনে আগমনের সংবাদে হযরত হাজী ছাহেব নেহায়েত খুশী হইয়া লিখিলেনঃ ‘আপনার থানা ভবন যাওয়া অতি উত্তম হইয়াছে। আশা করি, আপনার দ্বারা বহু লোকের যাহেরী-বাতেনী উপকার হইবে এবং আপনি আমাদের মাদ্রাসা ও মসজিদ পুণঃ আবাদ করিবেন। আপনার জন্য দোয়া করিতেছি।’ - মকতুবাত তিনি পার্থিব ধন-সম্পদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় থানা ভবনে আসিলেন। আল্লাহ পাক তাঁহার দ্বারা উম্মতে মোহাম্মদীয়ার বিরাট কর্ম সম্পাদন করাইলেন। পাক-ভারতের বিভিন্ন আঞ্চল হইতে দলে দলে বহু আলেম ওলামা, অর্ধ শিক্ষিত, সকল শ্রেনির লোকই তাঁহার দরবার হইতে ফয়েয হাসেল করিবার জন্য সমবেত হইত এবং প্রত্যেক নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী তাহা লাভ করিত। হাকীমুল উম্মত মোজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশ্‌রাফ আলী থানভীর ফয়েয ও বরকত ছিল বিভিন্ন মূখী ও সূদূরপ্রসারী। সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তাহা প্রকাশ করা সুদুরপরাহত। তাঁহার মধ্যে যে সব গুণাবলী বিদ্যমান ছিল, তাহা কয়েকজনে মিলিত ভাবে অর্জন করা সম্ভব নহে। তিনি একাধারে ছিলেন কোরআন পাকের অনুবাদক ও কোরআনের ব্যাখ্যাকার, মুহাদ্দিস, ফকীহ, এবং একজন লেখক। তিনি প্রায় এক সহস্র কিতাব রচনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে অনেক কিতাব বহু ভলিউম বিশিষ্ট তাঁহার রটচত প্রায় কিতাবই তাছাওউফে ভরপুর। তফসীরকার হিসাবে তিনি জগত বিক্ষাৎ। তাঁহার কৃত তফসীর “তফসীরে বয়ানুল কোরআন” অদ্বিতীয়। ওয়ায়েজ হিসাবে ছিলেন অতুলনীয়। তাঁহার তথ্যপূর্ণ বিভিন্ন মূখী ওয়ায সমূহ ওয়াযের সময় সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ করা হইত এবং পত্র-পত্রিকায়ও মুদ্রিত হইত। পরে এই গুলি পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়। তাঁহার রচিত পুস্তকাবলী ও ওয়ায সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদিত হইয়াছে।তাঁহার রচিত কোন কিতাবের স্বত্ত্ব সংরক্ষিত নহে। যে কেহ ছাপিতে পারে। কি অপূর্ব স্বার্থ ত্যাগ! বাংলা ভাষায়ও তাঁহার রচিত অসংখ্য কিতাব মুদ্রিত হইয়াছে ও হইতেছে। এল্‌মে দ্বীনের উত্তাদ হিসাবে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। অসংখ্য আলেমে হক্কানী তাঁহার হাতে গড়া। এতদ্ভিন্ন তিনি ছিলেন পীর ও মুর্শিদে কামেল।

তাছাওউফের দিক দিয়া তিনি ছিলেন মুজাদ্দিদে মিল্লাত বা যুগপ্রবর্তক। এক কথায় তিনি ছিলেন মুজতাহিদ যুগসংস্কারক। অনেক ছুফী, পীর এল্‌মে তাছাওউফকে বিকৃত করিয়া তুলিয়াছিল। তিনি এই বিকৃত তাছাওউফকে ত্রুটি যুক্ত বশতঃ জগৎ বাসীর সামনে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন। তাঁহারই সূক্ষ্ম ব্যবস্থা ও চিকিৎসা দ্বারা তাছাওউফের ভ্রান্ত পদ্দতির সংস্কার সাধিত হইয়াছে। বহু যোগ্য মুরীদকে খেরক্বায়ে খেলাফত দান করিয়াছেন। তাঁহার খলিফাগণের লক্ষ লক্ষ মুরীদ শুধু পাক-ভারতেই নহে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়াইয়া রহিয়াছে। (হায়াতে আশ্‌রাফ, সীরাতে আশ্‌রাফ দ্রঃ)

চির বিদায়ঃ

১৯ শে জুলাই ১৯৪৩ ইং সোমবার দিবাগত রাত্রে এশার নামাজের পর তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স হয়েছিল বিরাশী বছর তিন মাস এগার দিন। ইন্তেকালের দুইদিন পূর্বে পাঞ্জাবের এক মসজিদের ইমাম (সৈয়দ আনোয়ার শাহ্‌ কাশমীরীর শাগরিদ) স্বপ্নে দেখেন, আকাশ প্রান্তে ধীরে ধীরে লিখা হইতেছে ..............................(ইসলামের বাহু ভাঙ্গিয়া গিয়াছে)

কারামতঃ

১. এক ব্যক্তি হাকীমুল উম্মতের জন্য আখের গুড় হাদিয়া সরুপ আনিল, কিন্তু তিনি উহা গ্রহণ করিলেন না। পরে জানা গেল যে, ঐ গুড় ছিল জাকাতের।

৫. একবার তিনি লায়লপুর ষ্টেশনে গাড়ীর অপেক্ষায় ছিলেন। ষ্টেশন মাষ্টার চাকরকে ষ্টেশনের বাতি জ্বালাইয়া হযরতের হযরতের কামরায় দিতে আদেশ করিলেন। হযরত আল্লাহ পাকের দরবারে পরের হক নষ্ট করা হইতে বাঁচিবার দো‘আ করিলেন। মাষ্টারের মন মুহুর্তে পরিবর্তিত হইয়া গেল। তিনি চাকরকে তাহার নিজস্ব বাতি জ্বালাইতে দিতে আদেশ করিলেন।

৬. কানপুরে কলিমুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির হামেশা অসুখ লাগিয়া থাকিত। আরবী ‘কিল্ম’ (অর্থ জখম) হইতে এই কলিমুল্লাহ নামের উৎপত্তি বলিয়া তাঁহার নাম রাখিয়া দিলেন ছলিমুল্যাহ। অতপর ঐ ব্যক্তির কোন অসুখ হইত না।

৭. একবার হযরত থানভী (র:) কানপুরে বাশমন্ডীতে ওয়াজ করিতে ছিলেন। হঠাৎ ঝড় আসিল। হযরত তাঁহার শাহাদাৎ আঙ্গুলীতে ফুক দিয়া ঘুরাইলেন। তৎক্ষনাৎ ঝড়ের মোড় ঘুরিয়া অন্য দিকে চলিয়া গেল। ওয়াজের কাজ নির্বিগ্নে সম্পন্ন হইল।

৮, মাওলানা হাকীম আবদুল হক বলেন, যে ব্যক্তি হযরতের দরবারে খাঁটি নিয়তে বসিত তাহার আপনা হইতে পরিষ্কার হইয়া যাইত এবং দ্রুত আখিরাতের দিকে মন আকৃষ্ট হইয়া পড়িত।

একটি স্বপ্নঃ

৯. একবার হযরত মাওলানা যাফর আহামদ ওসমানী সাহেব স্বপ্নে দেখিলেন, মদীনা শরীফের এক বুযুর্গ তফ্‌সীরে বয়ানুল কোরআনের তা‘রীফ করিতে করিতে বলিলেন, নবী করিম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার বার বলিতেছেন, অমুক আয়াতের তফসীর বয়ানুল কোরআনে এই ভাবে লিখা আছে। হযরত ওসমানী বলেন, আমার ষ্পষ্ট মনে পড়ে আমি হযরত (দঃ) এর এই উক্তি নিজ কানে শুনিয়াছি। স্বপ্নে আমার ইহাও অনূভূত হইল যে, নবী করীমের দারবারে “বয়ানুল কোরআন” এরুপ মকবুল হওয়ার কারণ, হযরত মাওলানার পরিপূর্ণ এখলাছ।

২. হে হযরত হাকীমুল উম্মতের খেদমতে এসলাহের জন্য আসিলে তিনি তাহার গোপনরোগ ধরিতে পারিতেন এবং ঐ হিসাবে তাহার এসলাহ করিতেন। তাঁহার নিকট কোন রোগ গোপন রাখার উপায় ছিলনা।

৩. তাঁহার কোন ভক্ত রোগারোগ্যের জন্য দো‘আ চাহিয়া পত্র লিখিলে লেখার সঙ্গে সঙ্গে নিরাময় হইয়া যাইত।

৪. তাঁহার জনৈক খলিফা বলেন, একদা আলীগড়ের শিল্প-প্রদর্শনীতে দোকান খুলিয়াছিলাম। মাগরি্বের পর প্রদর্শনীর কোন এক ষ্টলে আগুন লাগে। আমি একাকী আমার মালপত্র সরাইতে সক্ষম হইতে ছিলাম না। আকস্মাৎ দেখিলাম, হযরত হাকীমুল উম্মত আমার কাজে সাহায্য করিতেছেন। তাই আমার বিশেষ কোন ক্ষতি হয় নাই। পরে জানিলাম, হযরত তখন থানা ভবনেই অবস্থান করিতে ছিলেন।

যদি থাকে নসিবে

যদি থাকে নসিবে, আপনি আপনি আসিবে..........
জোর করে মন হরণ করোনা, করে চলনা.........
এই যে ভিশন যন্ত্রনা...........

আপন মন হয় যদি মনের মতন.......
মনে মন করে আকর্ষণ.......
সেই মনে আর গুনে দরে না, রে মন দরে না......, সেই মনে আর গুনে দরে না.......
ভালো লাগলে ভালোবেসে......

কাছে বসে মুচকি হাসে.....
তাড়াইয়া দিলেও সরে না, রে মন সরে না.......
এই যে ভিশন যন্ত্রনা..................

বেহায়া মনা, শামছল হকে........
আশার মশাল জেলে বুকে.......
অন্ত্রে-যন্ত্রে করে সাধনা........
রে মন মিলে না.....

মন চোরা হালিম চাঁনদ.......
নিদায়া-নিঠুরো পাষাণ.....
আখিঁ জ্বলে মণ টলেনা, রে মন টলেনা.........
এই যে ভিশন যন্ত্রনা..........

বেহায়া মনটা লইয়া.........., আমি তোমারে ভালোবাসিয়া.....
আজ আমার ঘটিল জঞ্জাল...........................