যে প্রেম বিশ্ব জয় করতে জানে
মিশরের "লিমান তুররা" কারা হাসপাতালের চৌদ্দ শিকের দুইপাশে দাঁড়িয়ে বিয়ে হয়েছিলো দুজনের। বর একজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামী। অপরাধ অন্য কিছু নয়, মিশরের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া। ১৯৫৪ সালে যাঁকে গ্রেফতার করে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে কিছুদিন পর ফাঁসি বাতিল করে যাবজ্জীবন দেয়া হয়। কনে খুব ভালো করেই জানতেন এখানে যাবজ্জীবন মানে ২৫ বছরের আগে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। কারান্তরীণ ছেলের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর অনেক ভেবে তিনি এই কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হন।
বিয়ের কয়েকদিন পরের ঘটনা। সদ্য বিবাহিত এই যুবককে অমানবিক নির্যাতন করে "ক্বানা" নামক অন্য একটি কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই "ক্বানা" কারাগারটি ছিলো রাজধানী কায়রো থেকে অনেক দূরের একটা জায়গা। যুবকের নবপরিণীতা বধু ননদকে সঙ্গে করে সেই কারাগারে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। পথিমধ্যে অনেক ভোগান্তি সহ্য করতে হলো দুজনকে। যুবকের বোন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ভাবিকে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিলেন। যুবক তাঁর বধু ও বোনের পথিমধ্যে ভোগান্তির কথা জেনেছিলেন। তিনি অত্যন্ত আবেগ তাড়িত কণ্ঠে স্ত্রীকে বললেন, "দেখো, আমি আশাবাদী ছিলাম খুব অল্প দিনের মধ্যে হয়তো বের হতে পারবো। কিন্তু সেই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ দেখতে পাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট জামাল নাসের আমাদেরকে অফার করেছে, তাকে সাহায্য করলে সে আমাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দিবে। কিন্তু আমি বলে দিয়েছি, আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও আমি তার অন্যায় প্রস্তাবে রাজি হবো না। প্রিয়তমা, আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করি। আমার কারাগার থেকে মুক্তি পেতে হয়তো আরও অন্তত দুই দশক লেগে যাবে। তোমার এতো কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার জন্য তোমার সুন্দর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বরং তুমি এমন কাউকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করো যে তোমার পাশে সবসময় থাকতে পারবে। তোমার জীবনটাকে সুখে আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারবে।"
স্ত্রী স্বামীর কথা শুনলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই কারারক্ষীরা কারার লৌহকপাট বন্ধ করে দিলো। তিনি বাড়ি ফিরে গিয়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে একটি কবিতা লিখলেন। যার কিয়দংশ ছিলো এরকম,
"নিরন্তর পথ চেয়ে বসে আছি,
শুধু তোমার জন্য।
নাহয় সে পথ হোক জিহাদের।
লাল পথ ধরে পায়ে পায়ে
যাই চলো জান্নাতের দ্বারে।
সেই ওয়াদার খাতিরে,
ভয় কি?
লজ্জা কি?
কিসের বা বেদনা আমার?"
অবশেষে প্রায় ২০ বছর পর ১৯৭৩ সালে সেই যুবক মুক্তি পেলেন। ততদিনে বার্ধক্য এসে ভীড় করেছে। বিয়ের ২০ বছর পর প্রথমবারের মতো মুক্ত পৃথিবীতে প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো। আল্লাহর দ্বীনকে ভালোবেসে জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণ সময়গুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন থেকে যে দম্পতি ঈমানের এক অনন্যসাধারণ নজীর স্থাপন করলেন, মহাকালও হয়তো সেটা টুকে রাখলো। নীলনদের তীরে হয়তো বিশাল কোনো ঢেউ আঁচড়ে পড়ে সম্মান জানাতে চাইলো এ মজলুম দম্পতিকে। কায়রো শহরের পাখিগুলো হয়তো একবার কিচির মিচির ধ্বনি তুলে প্রকাশ করতে চাইলো তাদের আনন্দের কল্লোলিত বার্তা।
১৯৮১ সালের এক সন্ধ্যা। রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয়তম এই বান্দা-বান্দীকে আরেকটু পরীক্ষা করে ঈমানের চুড়ান্ত মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ করে নিতে চাইলেন বোধহয়। মিশরের ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম এ সিপাহসালারকে পুনরায় গ্রেফতার করা হলো। সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শাহাদাৎ বরণ করানো হলো। শহীদের সম্মানিতা স্ত্রী এবার চিরদিনের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। ১৯৮১ সালের ৬ নভেম্বর ভোরবেলা যে চুড়ান্ত নিঃসঙ্গ জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো, ২০০৭ সালের ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তার পরিসমাপ্তি ঘটলো। পরিসমাপ্তি ঘটলো একটি অনবদ্য অধ্যায়ের। এই মহীয়সী নারীর নাম আমিনা কুতুব। মিশরের ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষনেতা সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (রহঃ) এর ছোটবোন। তাঁর স্বামী ইখওয়ানের অন্যতম নেতা শহীদ কামাল আল সানানিরী। আল্লাহকে যাঁরা সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসতে পেরেছে, তাদের গল্পগুলো তো এমনই হবে। জাগতিক সব চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেষ আর ঠুনকো স্বার্থবাদী চিন্তাধারা তাদের পদতলে এসে লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে ফিরবে বারবার। আর আল্লাহর পথের সেনানীরা তার উপরে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করে যাবেন, "সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত। আর মিথ্যা তো অপসৃত হবার জন্যই।" [সূরা বনী ইসরাইল-৮১]
"যে জীবন সাহসের আগ্নেয়গিরি"/ মু. লাবিব আহসান
collected from
internet