আমার কাছে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের কোয়ালিটি কত ভাল বা খারাপ, সেটি বোঝার জন্য খুব সাধারণ একখানা মানদন্ড আছে । মান যাচাইয়ের এই মাপকাঠিখানা নিতান্তই আমার নিজস্ব । কারও সাথে নাও মিলতে পারে ।
সেটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি তার মানুষগুলোকে কিভাবে ট্রিট করছে । অর্থাৎ, কোম্পানীর People treatment কেমন ? কর্মীদের সাথে ব্যবহার কেমন ?ভাবছেন প্রোডাক্টের কোয়ালিটির সাথে People treatment এর সম্পর্কটা কি ? আছে, সম্পর্ক আছে । সেটাই বলছি ।
'Quality' এমন একখানা বিষয় যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না । কিছু সংখ্যা আর অংক দিয়ে মাপার চেষ্টা করা গেলেও 'কোয়ালিটি'র মূল ধারণাটা কিন্তু আসলে কাজ করে মানুষের মাথার ভেতর, অর্থাৎ সাইকলজিক্যাল একটা বিষয় । এমন একখানা জটিল মন:স্তাত্ত্বিক বিষয়কে যদি আপনি আপনার প্রোডাক্টের ভেতর আনতে চান তবে শুধু প্রসেস ডেভেলপ করলেই হবে না, বা কর্মীদের জন্য বিস্তর ট্রেইনিং বা প্রতিদিন একবার করে লেকচার দিলেও হবে না । বরং কোয়ালিটি'র কনসেপ্টখানা কর্মীদের মাথার একদম ভেতরে গেঁথে দিতে হবে । তাঁদের সচেতন এবং অবচেতন মনে ঢুকিয়ে দিতে হবে । এটি যদি করা যায়, শুধুমাত্র তখনই দেখবেন কর্মীগণ কোয়ালিটির ব্যপারে সেন্সিটিভ হয়ে উঠবে । Process আর KPI গুলো তখন কাজ করবে এই সেন্সিটিভিটিকে কাজের প্রসেসে এনে পুরো অপারেশনের ‘কোয়ালিটি’ আনতে ।
একখানা উদাহরণ দেই । ধরুন আপনি খাবার পণ্য বানান । এবং আপনার ইচ্ছা খুব হাই কোয়ালিটির পণ্য বানাবেন । আপনি বিজনেস প্ল্যানও করেছেন সেভাবে । সেইমতো কর্মীদেরকে আপনি নানান রকম ট্রেইনিংও দিয়েছেন । কিন্তু কর্মীদের জন্য আপনি যে দুপুরের খাবার দেন সেটির মান খুবই খারাপ ! নিম্নমানের খোলা খাবার । ডাইনিংয়ের hygiene ব্যবস্থাও খুব খারাপ ! আবার কর্মীদের যে স্ন্যাক্স দেয়া হয় সেটি রাস্তার পাশের খোলা দোকান থেকে কিনে আনা মুড়ি-ছোলা মাখা ধরণের খাবার ! Low quality, Unhygienic । কিংবা তাঁদের TA-DA তে যে টাকা দেয়া হয়, তা দিয়ে রাস্তার পাশের শস্তা হোটেলের খাবার ছাড়া কোথাও খাওয়া সম্ভব নয় !
এই পরিবেশে এমন খাবার যখন আপনার মানুষগুলো প্রতিদিন খাবেন, তখন তাঁদের মাথার ভেতর একটা সিগনাল যাবে যে এমন কোয়ালিটির খাবার খেলেও আসলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই - আমরাই তো রোজ খাচ্ছি । এটা আসলে তেমন কোনো ব্যপার না । একটু কম্প্রোমাইজ করাই যায় । এতে ক্ষতি নেই ।
কিন্তু আসলেই কি ক্ষতি নেই ? আমার হিসেবে ক্ষতি কিন্তু আছে ।
কি জানেন ? এই লোকগুলোই যখন আপনার প্রোডাক্টের জন্য কাজ করবে তখন একটু একটু করে হলেও কম্প্রোমাইজ করবে । যে লোকটা ফ্যাক্টরীতে কাজ করে, সে প্রোডাকশন প্রসেসে একটু বেখেয়ালি হবে, যে কোয়ালিটি চেক করার সে একটু ঢিলেমী দিবে, যে ডিস্ট্রিবিউশনে কাজ করে সে একটু দেরী করবে বা হেলায়-ফেলায় প্রোডাক্ট হ্যান্ডেলিং করবে, যে সেলসে কাজ করে সে সেলস সার্ভিসে একটু কম আন্তরিক হবে, মার্কেটিংয়ের লোকটা কনজ্যুমার ইনসাইট বুঝতে একটু আলসেমী করবে, ভাল কম্যুনিকেশন দাঁড়া করাতে কিছুটা ঢিলেমী করবে, ফাইন্যান্সের লোকটা একটু হলেও হিসেবে-নিকেশে সহজ হবে, যাক না কিছু টাকা কি আর হবে - এমন একটা মানসিকতা থাকবে তাঁরও । এইচ আরের লোকটি ভাল কর্মী বাছাই করতে কিছুটা উদাসীন থাকবে কিংবা ভাল কর্মীদের ধরে রাখতে একটু কম সিরিয়াস থাকবে ।
মোদ্দা কথা সবার মাথার ভেতর অবচেতন মনে হলেও একটা ব্যপার বার বার কাজ করবে - "এটা আসলে তেমন কোনো ব্যপার না । একটু কম্প্রোমাইজ করাই যায় । এতে ক্ষতি নেই ।"
এখন চিন্তা করে দেখুন এই ভাবে যখন প্রতিটা ফাংশনের লোকগুলো একটু একটু করে ছাড় দিবে, তখন আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের মানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? একটু কম মানের Raw materials কেনা হবে, প্রোডাকশনে ভুলভাল হবে, Distribution এ Inefficiency আসবে, সেলসে এফিসিয়েন্সি কমবে, Communication গুলো ধারালো হবে না, হিসেব-নিকেশে একটু একটু করে ফাঁক তৈরী হবে, এবং সর্বোপরি আপনার প্রতিষ্ঠানের লোকগুলো সবচেয়ে চৌকশ হবে না, এমনকি আপনি চৌকশ লোক হায়ার করলেও হয় তাঁরাও ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাবে অথবা মানিয়ে নিতে না পেরে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাবে ।
খেয়াল করে দেখুন এর সব কিছুই হচ্ছে কারণ আপনি কর্মীদের খাবারে কোয়ালিটি মেইনটেইন করেন নি । সামান্য কয়েকটি টাকা বাঁচানোর জন্য আপনি তাঁদের সামনে কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ করার একখানা উদাহরণ স্থাপন করেছেন । ব্যস, সাথে সাথে সবাই সেই উধাহরণটিকে নিজের মত নিজ নিজ কাজে এ্যাপ্লাই করে ফেলেছেন । আপনি যদি উল্টোভাবে হাই-কোয়ালিটি'র উধাহরণ স্থাপন করতেন, কর্মীদের ভেতরেও তার প্রভাব হত ঠিক তেমনই । এটি শুধু খাবারের ক্ষেত্রে নয় । আমি সব ব্যপারেই বলছি । সুতরাং, শ'খানেক ট্রেইনিং আর প্রসেস করালেও লাভ নেই, যদি না 'কোয়ালিটি' ব্যাপারখানা আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতিটা কাজে ইন-বিল্ট না করে হয় । সেটি না করা হলে দিন শেষে সবই থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর !
বিশেষত: করোনার ভেতরে আমি আরেকটা ব্যপার খুব খেয়াল করেছি । প্রতিষ্ঠানগুলো তার কর্মীদের কিভাবে যত্ন নিয়েছে । ব্যবসায় চাপ আসতেই পারে, এসেছেও । কিন্তু কঠিন সময়ে যদি প্রতিষ্ঠান যদি তাঁর কর্মীদের বুকে ধরে আগলে না রাখে বা অন্ত:ত রাখার মত মানসিকতা দেখায়, তবে তারা আদৌ তাদের কনজ্যুমারদের প্রতি যত্নশীল হবে, কনজ্যুমারদের জন্য ভাল মানের প্রোডাক্ট বানাবে সেটি আশা করাটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয় । আপনার আশেপাশে যে লোকগুলো আপনার জন্য সকাল-সন্ধ্যা প্রানপাত করে পরিশ্রম করছে, যারা আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজেদের মেধা-সময়-শ্রম দিচ্ছেন, আপনি সেই মুখ চেনা লোকগুলোকেই কেয়ার করছেন না, সেক্ষেত্রে আপনি অচেনা-অজানা ক্রেতার জন্য কি কেয়ার করতে পারেন সেটি বোঝাই যায় ! আপনাদের মুখ-চেনা কর্মীদের জন্য যদি আপনার বিন্দুমাত্র মায়া না থাকে, তবে অচেনা কনজ্যুমারদেরকে আপনি যা ইচ্ছে তা গছিয়ে দিতে পারেন তাতে আর অবার হবার কি আছে !
তাই দেখবেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে নামকরা প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম সেরা জিনিষ থাকে People treatment. কর্মীদেরকে তারা প্রচন্ড মূল্য দেয়, শ্রদ্ধা করে, ছোট ছোট সুবিধা-অসুবিধার দিকেও খেয়াল করে, সেই মত ব্যবস্থা নেয় । প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা হাই-কোয়ালিটি একটা ইমেজ বজায় রাখে, যেটি তাদের কর্মীদের মাথার ভেতর হাই-কোয়ালিটি প্রোডাক্ট তৈরী বা সার্ভিস ডেলিভারী দেয়ার দায়িত্ববোধটা গেঁথে যায় ।
যেসব প্রতিষ্ঠান People First কনসেপ্টে বিশ্বাসী এবং সেই কনসেপ্টেকে অপারেশনের প্রতিটা ক্ষেত্রে মনে প্রাণে লালন পালন করে, শুধুমাত্র তাঁদের ক্ষেত্রে ‘কোয়ালিটি’ ব্যপারটি আসে এবং শক্তভাবে রয়ে যায় । কারণ দিনশেষে Quality is a total concept, আধাভাংগা কিছু নয় । হয় আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস Quality-full হবে, নয়তো হবে না । এর মাঝামাঝি বলে কিছু নেই ।
তাই বলছিলাম আমার কাছে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের কোয়ালিটি কত ভাল বা খারাপ, সেটি বোঝার জন্য খুব সাধারণ একখানা মানদন্ড আছে । সেটি হলো কোম্পানীর People treatment কেমন, কর্মীদের সাথে ব্যবহার কেমন ।.তবে মান যাচাইয়ের এই মাপকাঠিখানা একান্তই আমার নিজস্ব, আমার দীর্ঘদিনের অবজার্ভেশন আর Human psychology’র understanding থেকে বোঝা । আপনি এর সাথে একমত না হলেও কোনো বিতর্ক নেই ।